বিশেষ প্রতিনিধি ঃ
বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম গতকাল দেশের সকল সাংবাদিক সংগঠনকে সরকারীভাবে তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রনালয়ের আওতায় নিবন্ধনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম- বিএমএসএফ।
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আবু জাফর গতকাল মন্ত্রী পরিষদ সচিবের কাছে এ সংক্রান্ত একটি আবেদন দাখিল করেছেন। আবেদনে বলা হয় দেশের সাংবাদিক সংগঠনসমুহকে সরকারের পক্ষ থেকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হলে সংগঠনসমুহের মাঝে ঐক্য ও সমন্বয়ের সূচণা হবে।
পেশাজীবী সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে পারস্পারিক ভুল বুঝাবুঝি, দ্বন্ধ সংঘাতে চরম অনৈক্য থাকায় সাংবাদিকরা যেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে তেমনি সরকারও বিভিন্ন সময় বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে। নানা দুর্যোগ, দুর্বিপাকে সাংবাদিকদের জন্য সরকারের বরাদ্দ দেয়া সাহায্য সহায়তাও যথাযথ ভাবে পৌছানো সম্ভব হয় না। উদাহরনস্বরুপ বলা হয়, সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্বাস্থ্যসেবার যাবতীয় প্রতিষ্ঠান/সংগঠনকে নিবন্ধন দিচ্ছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় দেয়া হচ্ছে এনজিওসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ক্লাবসমুহের নিবন্ধন। তেমনি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় নারী ও শিশু সংগঠনসমুহ, কৃষি অধিদপ্তরের আওতায় কৃষি সংগঠন, শ্রম অধিদপ্তরের মাধ্যমে শ্রমিক সংগঠন, সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে সমবায়ী সংগঠনসমূহের নিবন্ধনভুক্ত করা হয়। তাহলে মিডিয়াভুক্ত কর্মি ও সাংবাদিক সংগঠনসমূহকে কেন তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন আওতায় আনা হচ্ছে না?
যথাযথ মন্ত্রনালয়ের আওতায় সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নিবন্ধন ব্যবস্থা না থাকায় ভূয়া আর ভন্ড প্রতারকরা এ সুযোগের সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করে চলছে। ঢাকাসহ সারাদেশে অপসাংবাদিক ও ভূয়া চক্র জোট বেধে (জয়েন্ট স্টক) অথবা সমাজ সেবা কিংবা সমবায় দপ্তর থেকে নিবন্ধন করিয়েই যে কোনো সাংবাদিক সংগঠন খুলে বসছে, চালিয়ে যাচ্ছে বহুমুখী বাণিজ্য।
ভন্ড, প্রতারক, ভূয়ারা সংঘবদ্ধভাবেই নানা অপকর্ম সাধনের অস্ত্র হিসেবে এসব সংগঠনকে ব্যবহার করে থাকে। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে গড়ে উঠেছে শত শত ভূইফোঁড়, সাইনবোর্ডসর্বস্ব সাংবাদিকদের সংগঠন। এমনই একটি সংগঠন ‘যাত্রাবাড়ী-কদমতলী-ডেমরা অ্যান্ড শ্যামপুর প্রেসক্লাব ফাউন্ডেশন। মিরপুর, উত্তরা ও তুরাগ এলাকায় রয়েছে বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ও ঢাকা ক্রাইম রিপোর্টার্স ইউনিটির মতো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। বাড্ডা, ভাটারা, খিলক্ষেত এলাকায় গড়ে উঠেছে ‘ঢাকা মেট্টোপলিটন প্রেসক্লাব’, মতিঝিলের খালপাড়ে আছে ২২০০ জন কথিত সাংবাদিকের ‘ঢাকা প্রেসক্লাব’, যাত্রাবাড়ী থানায় কর্মরত পুলিশের সোর্সরা তৈরি করেছে ‘ক্রাইম রিপোর্টার্স সোসাইটি’, গুলিস্তান মার্কেটে গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ রিপোর্টার্স ক্লাব।’ ভূইফোড় এসব সংগঠন টাকার বিনিময়ে সারাদেশে শাখা-প্রশাখা পর্যন্ত অনুমোদন দিয়ে চলছে। কাওরানবাজার সিএ ভবনের লিফটম্যান নানা নামে ভ‚ইফোড় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বানিয়ে শুধু মিরপুরেই তিন শতাধিক সাংবাদিক নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের সমন্বয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন “সাংবাদিক কল্যান-অপারেটিভ লিঃ” ও “ঢাকা মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাব” নামের কথিত দুটি সাংবাদিক সংগঠন। মিরপুর, পল্লবী, রুপনগর, ভাসানটেক জুড়ে কথিত সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য সুস্থ্য সচেতন মানুষের মধ্যে ঘৃণার বিস্তার ঘটাচ্ছে।
কথিত সাংবাদিক পরিচয়ধারী প্রতারকরা প্রায় সকলেই নানা রকম মামলার আসামি। তারা রাত দিন নানা ধরনের ধান্দাবাজি, চাঁদাবাজি ও থানা পুলিশের ঘুষ দালালী কর্মকান্ডে সদা ব্যস্ত থাকেন। পরিচ্ছন্ন কর্মি থেকে শুরু করে টেম্পো চালক, মুদি দোকানি, সবজি বিক্রেতা, গাড়ির মেকারকে পর্যন্ত সাংবাদিক কার্ড বিতরণ করে চলছেন। বিতরণ তো নয়, রীতিমত সাংবাদিক কার্ড বিক্রির মহোৎসব শুরু করেছেন প্রতারকরা। তাদের জিজ্ঞাসা করলেই জবাব আসে, ‘আমার সাক্ষরে সাংবাদিকদের আইডি কার্ড দেই, আমি কোন্ পত্রিকার সাংবাদিক সে পরিচয় আলাদাভাবে দেয়ার কী আছে?’
কথিত সাংবাদিকরা নানা সিন্ডিকেটে বিভক্ত হয়ে অভিনব সব কৌশলে প্রতারণা চালিয়ে আসছে।
প্রতিটি সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকেই তথাকথিত ‘অনলাইন নিউজ পোর্টাল’ তৈরি করে তার আওতায় নিজেদের আইডি কার্ডও বানিয়ে নেয় তারা। গন্ডমূর্খ একেকজন রাতারাতি চীফ রিপোর্টার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, নিউজ এডিটর, এডিটর পদবী ধারন করে রঙবেরঙের ভিজিটিং কার্ড বিলিয়ে বেড়ান, যত্রতত্র গড়ে তোলেন প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ক্লাব, ক্রাইম রিপোর্টার্স সোসাইটি ইত্যাদি নামের ভূইফোড় সংগঠন। এসব সংগঠনের ব্যানারে চলে নানা অজুহাতের চাঁদাবাজি। বৃহত্তর মিরপুরে নানা নামে ৯টি প্রেসক্লাব গড়ে উঠেছে, উত্তরায় সাংবাদিক সংগঠনের সংখ্যা এক ডজন ছাড়িয়ে গেছে। যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছয়টি প্রেসক্লাব ও রিপোর্টার্স ইউনিটি রয়েছে। একইভাবে টঙ্গীতে প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক যুক্ত করে সাতটি, আশুলিয়ায় চারটি, গাজীপুরে ৮টি সংগঠন গড়ে উঠেছে।
সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্রের সদস্যরা একেকজন ডজন ডজন মামলার আসামি হওয়া সত্তেও থানা পুলিশের একশ্রেণীর কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের গলায় গলায় পীড়িত। তারা কখনও গোয়েন্দা সদস্য ও থানা পুলিশের সোর্স হয়ে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকায় চাঁদাবাজিও করে থাকে। আবাসিক হোটেল, ফ্ল্যাট বাড়ি, বেকারি, কারখানা, ইজিবাইক পরিবহন, কমার্শিয়াল ব্যবসায়ী, আদম পাচারকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নিচ্ছে চক্রটি। বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক সোসাইটি নামের আরেকটি ভ‚ইফোড় সাংবাদিক সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেছে যে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মহাসচিব গ্রামে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে প্রার্থী হয়েছেন। সারাদেশ থেকে তাদের সাংবাদিক নেতারা দামোদর গ্রামে তার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত।
সাবেক দক্ষিণখান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেনও শখ করে বানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাব, নিজেই সংগঠনটির চেয়ারম্যানও হয়েছেন। জয়েন্ট স্টক থেকে রীতিমত লাইসেন্সও করিয়ে নিয়েছেন। এবার বুঝুন ঠ্যালা। ধান্দাবাজদের বাণিজ্য সফলতা দেখে রাজধানীরও থানায় থানায় প্রেসক্লাব গজিয়ে ওঠার সীমাহীন দৌড়ঝাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রঙ বেরঙের পোস্টার বানিয়ে প্যানেল তৈরি করে সেসব প্রেসক্লাবে নির্বাচন প্রতিযোগিতাও চলছে। মূলধারার না হোক নিয়মিত প্রকাশিত হয় এমন কয়টা সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টার সেখানে আছেন? প্রকৃত রিপোর্টার সংখ্যা কম হওয়ায় গাজীপুরের টঙ্গী থেকেও সংবাদদাতা হাওলাত এনে বানানো হয় উত্তরা প্রেসক্লাব। মিরপুরের এক প্রেসক্লাবে সদস্য ঘর পূরণ করা হয়েছে আশুলিয়া থানার দুই রিপোর্টারকে যুক্ত করে। হানিফ সংকেতের গল্প’র মতো মিরপুর পল্লবীর আরেক প্রেসক্লাবে চলে শুধু বহিস্কার পাল্টা বহিস্কারের পালা।
সভাপতিসাহেব সেক্রেটারীকে বহিস্কার করলে তিনি আবার নতুন সভাপতি নিয়োগ দিয়ে সাইনবোর্ডটা টিকিয়ে রাখেন। তবুও তাদের প্রেসক্লাব চাই ই চাই। ব্যবসা বাণিজ্য সফল করার নেশায় মেতে উঠে পুরান ঢাকার স্ব-ঘোষিত অনলাইন রিপোর্টাররাও। প্রেসক্লাব কিংবা সাংবাদিক নাম যুক্ত করা সংগঠন খুলে কিসের লাভ? পেশাদারিত্বের কোনো বালাই নেই, নেই একদিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালাও। কিন্তু লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নৌভ্রমণ, পিকনিক আয়োজনে তাদের বেজায় শখ।