গাজীপুর থেকে আব্দুল হামিদ খানঃ
‘মন্ত্রীর বাসায় বসে এক ঘন্টায় অর্ডার (গাজীপুরে পোস্টিং আদেশ) করিয়েছি। ঘর দিব, টাকা খাবো, ঘর ভাঙবো। আমি দায়িত্ব নিয়ে (বনে ঘরবাড়ি নির্মাণে সহযোগিতা) করি। আমি তো একটু বেশি খাবোই। আমি যে কি মাল সেটা সবাই জানে।’ একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, দাম্ভিকতার সাথে এই কথাগুলো বলছেন গাজীপুরে কর্মরত ফরেস্ট গার্ড শেখ শহীদুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বন বিভাগের শ্রীপুর রেঞ্জাধীন সাতখামাইর বিটে কর্মরত।
অভিযোগ উঠেছে, সাতখামাইর বিট কর্মকর্তা নোয়াব হুসেন শিকদারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে শেখ শহীদুল ইসলাম বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। বিটের বিভিন্ন এলাকায় গেজেটভুক্ত বনভূমিতে ঘরবাড়ী নির্মাণের সুযোগ করে দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকা৷ অথচ একের পর এক এমন শেখ শহীদুলের মতো অসাধু বন কর্মচারিদের ঘুরে ফিরে গাজীপুরে পোস্টিং দিয়ে জেলার নৈস্বর্গিক বনাঞ্চল বেহাতের সুযোগ করে দিচ্ছে বন অধিদফতর।
সরেজমিনে সাতখামাইর বিটের বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, শুধুমাত্র ছাতির বাজার এলাকাতেই গত দুই বছরে কমপক্ষে কয়েক’শ ঘরবাড়ীসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মিত হয়েছে গেজেটভুক্ত বনভূমিতে। বর্তমান প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী দায়িত্ব গ্রহণের পর পর কৃষি জমি হিসেবে ব্যবহৃত বনভূমি জবরদখল মুক্ত করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। অথচ সাতখামাইর বিটে গেজেটভুক্ত বনভূমি অসাধু বন কর্মচারিদের সহায়তায় কোথাও ধান ক্ষেত, কোথাও আবার সবজি ক্ষেত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মাসোহারা ভিক্তিক এসব জবরদখলকৃত বনভূমিতে বিভিন্ন সময় চারা গাছ লাগিয়ে জবরদখল উচ্ছেদের হুমকি দিয়েও টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, সাতখামাইর বিট কর্মকর্তা নোয়াব হুসেন শিকদারের সঙ্গে আতাত করে এসব ঘরবাড়ী থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন শেখ শহীদুল ইসলামসহ বিটের অন্য কর্মচারিরাও। সম্প্রতি এসব ঘুষ বাটোয়ারার খবর বন বিভাগের উচ্চ পর্যায়ে চাউর হলে ছাতির বাজার এলাকায় লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালায় বন বিভাগ। অথচ অভিযানে ছাতির বাজার এলাকায় বনভূমি জবরদখলকারী বারেক ও কামালসহ তিনজনের কাছে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন শেখ শহিদুল ইসলাম।
সরেজমিনে আরও জানা গেছে, সাতখামাইর বিট কর্মকর্তা নোয়াব হুসেন শিকদার ও ফরেস্ট গার্ড শেখ শহীদুল ইসলামের ছত্রছায়ায় ছাতির বাজার এলাকায় গেজেটভুক্ত বনে যারা পাকা বিল্ডিং ঘর নির্মাণ করেছেন তারা হলেন- ইউসুফ আলী, হাসান, নয়ন, হেলাল পাঠান, সোহেল রানা, তারা মিয়া, মিলন, সিদ্দিক, শামিম, মাসুদ, সিরাজ, আব্দুর রহমান, হেলাল উদ্দিন, আব্দুর রহমান তাপস, আবুল কাশেম মিন্টু, আজিজুল, মামুন, শহীদ, বেলাল হোসেন, নাসির মৃধা, আব্দুল খালেক ও শফিকুল ইসলামসহ আরও অনেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বন বিভাগে কর্মরত তিনজন কর্মচারি জানান, বন অধিদফতরের কেন্দ্রীয় অঞ্চল দফতরে কর্মরত প্রধান সহকারি আবুল কালাম আজাদের ভগ্নিপতি সাতখামাইর বিট কর্মকর্তা নোয়াব হুসেন শিকদার। নোয়াব হুসেন শিকদারের আর এক শ্যালক গাজীপুর রাজেন্দ্রপুর পশ্চিম বিট কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। ওই তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে সৃষ্ট বলয়ে বর্তমানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে শ্রীপুর রেঞ্জে কর্মরতরা। ফলে শেখ শহীদুল ইসলামের প্রকাশ্য ‘ঘুষ কান্ডে’ শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মীর মো. বজলুর রহমান এখন নিরব দর্শকের ভূমিকায়।
বন অধিদফতরের নথি বলছে, বিগত ২০১৩ সালের ২৫ জুলাই তৎকালীন ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অবনী ভূষণ ঠাকুর এক অফিস আদেশে (অফিস আদেশ নং- ১০৪) ফরেস্ট গার্ড শেখ শহীদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। অসদাচরণের কারণে ১৯৮৫ সনের সরকারি কর্মচারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি ১১(১) বিধি মোতাবেক শেখ শহীদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তৎকালীন সময়ে তিনি গাজীপুর রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জাধীন মনিপুর বিটে কর্মরত ছিলেন।
বন অধিদফতরের নথি বিশ্লেষণে আরও জানা গেছে, বিগত ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই মনিপুর বিটের বেগমপুর এলাকাতে রাত ১০টায় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বনভূমি জবরদখল কারীদের কাছে বকেয়া ঘুষের টাকা না পেয়ে তাদের গালিগালাজ করেন শেখ শহীদুল ইসলাম। পরে ওই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাকে সালনা বিট কাম চেক স্টেশন অফিসার (বর্তমানে শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা) মীর মো. বজলুর রহমানের জিম্মায় দিয়ে আসে। শেখ শহীদুল ইসলামের এমন অসদাচরণের ঘটনা মীর মো. বজলুর রহমানসহ তৎকালীন রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এই ঘটনার পরের দিন শেখ শহীদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে বন বিভাগ।
শেখ শহীদুল ইসলামের বেপরোয়া কর্মকান্ডে ভয়ে টটস্থ ছাতির বাজার এলাকার অধিবাসীরা মুখ খুলতে সাহস হারিয়ে ফেলেছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই ব্যক্তি জানান, বনে ঘরবাড়ী নির্মাণ করতে চাইলে শেখ শহীদুল ইসলামকে টাকা দিতেই হবে। টাকা না দিলে বন মামলার আসামি হতে হবে। যারা টাকা দিয়ে বনে ঘরবাড়ী নির্মাণ করছে তাদের স্থাপনা কখনো উচ্ছেদ করা হয় না। তবে বেশি চাপ পড়লে কয়েকটি বিল্ডিং ঘরে নামমাত্র হাতুড়ি পেটা করে দায় সারে বিট কর্মকর্তার নেতৃত্বে শেখ শহীদুল ইসলাম। আবার উচ্ছেদ অভিযানের ভয় দেখিয়েও জবরদখলকারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। শেখ শহীদুল ইসলাম হাতে থাকলে সাতখামাইর বিটের যেকোনো এলাকায় পছন্দনীয় গেজেটভুক্ত বনভূমিতে বাড়ী করা যায়।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে সাতখামাইর বিট কর্মকর্তা নোয়াব হুসেন শিকদার ও বনপ্রহরি শেখ শহীদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আগেও বনের জমিতে ঘর ছিল, এখনো আছে। উচ্ছেদ অভিযানও অব্যাহত আছে। আমাদের ছত্রছায়ায় বনের জমিতে ঘর বা অবকাঠামো গড়ে উঠার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
শেখ শহীদুলের বিরুদ্ধে কেনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মীর মো. বজলুর রহমান বলেন, ব্যবস্থা নেবেন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ, সরাসরি আমার ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। বনপ্রহরির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে বিট কর্মকর্তা আমাকে রিপোর্ট করবেন, পরে আমি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করতে পারি।
Comments
comments