ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস ২০২৩। আজ মঙ্গলবার (১৪ মার্চ)। যাকে আরেকভাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক নদী রক্ষায় করণীয় দিবস। ১৯৯৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলের কুরিতিয়া শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ থেকে আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নদীর প্রতি মানুষের করণীয় কী, নদী রক্ষায় দায়িত্ব, মানুষের দায়বদ্ধতা কতটুকু; এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এমন দিনে আজ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে গত ৫৮ বছরে ১৫৮ নদী মরে গেছে। ভারতের সাথে যৌথ নদী কমিশন, নদী রক্ষা কমিটি গঠন এবং পরিবেশবাদীদের আন্দোলন কোনো কিছুই নদীকে রক্ষা করতে পারছে না।
ভারত থেকে প্রবাহিত প্রধান প্রধান নদী থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহার, বাঁধ নির্মাণ এবং দেশের ভেতরে অপরিকল্পিত রাস্তা-কালভার্ট নির্মাণের ফলে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে নদীগুলো ধীরে ধীরে মরে যাবার সংকটের কথা জানিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বিশিষ্ট গবেষক ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন… বাংলাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ, যার সৃষ্টি নদীবাহিত পলি থেকে। পদ্মা , মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী। ছোট বড় অনেক উপনদী এসে এসব নদীতে মিশেছে। এসব নদ-নদী বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বৈচিত্র্য দান করেছে। বলতে গেলে এ নদীগুলোই বাংলাদেশের প্রাণ। সে জন্যই নদীর সাথে বাঙালির রয়েছে নাড়ীর টান। তাইতো গীতি কবি লিখেছেন- “এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে, আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়, এই আমার দেশ এই আমার প্রেম”।
বাংলাদেশের নদীগুলোর অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণমুখি হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।আর কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের চাষাবাদ ব্যবস্থা অনেকটাই নদীর সেচ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কৃষির উন্নয়নে নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা প্রায় ৭০০ টি এ নদ-নদীগুলোর উপনদী ও শাখানদী রয়েছে। উপনদী শাখানদীসহ) বাংলাদেশের নদীর মোট দৈর্ঘ্য হলো প্রায় ২২,১৫৫ কিলোমিটার ।
বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা কত এইটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আমাদের সমাজে ও বিসিএস ভিত্তিক বইগুলোতে ৭০০ বা ২৩০ টি এই তথ্য প্রচলিত রয়েছে। তবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর গবেষণা মতে বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা ৪০৫ টি ।
বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই শত শত নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা পলি মাটি জমে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীসমূহের তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলঃ> বাংলাদেশের প্রধান নদনদীসমূহ:-নদীমাতৃক বাংলাদেশে অসংখ্য নদনদীর মধ্যে অনেকগুলো আকার এবং গুরুত্বে বিশাল। এসব নদীকে বড় নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বৃহৎ নদী হিসেবে কয়েকটিকে উল্লেখ করা যায় এমন নদীসমূহ হচ্ছে: পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলি, শীতলক্ষ্যা, তিস্তা, গোমতী ইত্যাদি।
নদীমাতৃক এ দেশটি স্মরণাতীতকাল থেকে মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধশালী। আর তাইতো বাঙালিকে বলা হয় `মাছে ভাতে বাঙালি।`
বাংলাদেশ ধীরে ধীরে শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলো বিভিন্নভাবে নদীর পানি ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া নদীপথে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় বড় শিল্প-কারখানা নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠেছে।
বৈচিত্রেভরা এই বাংলাদেশে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদী। এসব নদী এদেশকে করেছে সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা। তাই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আজ অনেক নদী মারাত্মক দূষণের শিকার। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী অন্যতম। শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য, ডাইং ফ্যাক্টরীর বর্জ্য এবং গৃহস্থালী পয়ঃবর্জ্য অনবরত নির্গত হচ্ছে নদীতে। এর ফলে নদী হয়ে পড়েছে মারাত্মক দূষণযুক্ত। পানি হয়ে পড়েছে বিবর্ণ কালো।
একদা প্রধান যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণের মাধ্যম নদীপথ এখন মৃত। নৌপথ সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে পানি শুষ্কতার ঝুঁকি। একই সঙ্গে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদেরা।
ওদিকে, দেশের দক্ষিণ-পশিমাঞ্চলের অনেক নদীতে এখন শুধু জোয়ারের সময় লঞ্চ-ট্রলার চলাচল করতে পারলেও ভাটার সময় এসব নৌরুট অচল হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে চর বা ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে গোটা নদীপথ জুড়ে। এসব নদীতে অনেক স্থানে ফেরি চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে।
সবচেয়ে হতাশার বিষয় হচ্ছে- ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’- এমন অবস্থায় পড়ে নদী তাঁর জীবন রক্ষা করতে পারছে না। বাংলাদেশে নদীপথে চলাচলের বিষয়টি দেখ-ভাল করছে আভ্যান্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (আইডব্লিউটিএ); নদীর তীর রক্ষা এবং খননের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড; নদীর জমির মালিক হিসেবে তা ইজারা দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়কে; নদীর পানির ব্যবহার উপযোগিতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের; নদীতে যে মাছ আছে তার মালিক ফিসারিজ বিভাগ; আর ডলফিন, কুমিরের মত বিলুপ্তপ্রায় প্রাণি রক্ষা করছে বন মন্ত্রণালয়।
ফলে দেখা যাচ্ছে সরকারের একাধিক কর্তৃপক্ষ একা এক নদীকে নিয়ে কর্তৃত্ব করছে গিয়ে খোদ নদীটির হয়েছে মরণ দশা।
নদীর বিপন্ন দশা প্রসঙ্গে ‘পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলন’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, পরিবেশ, অর্থনীতি, কৃষি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্যই নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে দিতে হবে; দূষণ ও দখল থেকে মুক্ত করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই,এক সময় নদীর পানি দিয়ে মানুষজন প্রয়োজনীয় গৃহস্থালী কাজ সারতো, নদীপাড়ে বিকেলে ঘুরে বেড়াতো। এখন বেড়ানোতো দূরে থাক দুর্গন্ধের কারণে নদী পারাপার হতে হয় নাকে রুমাল দিয়ে। নদীর পানি দিয়ে এখন গৃহস্থালী কাজও করা যায় না।
দূষণের মাত্রা এতই বেড়েছে যে, নদীর পানি ড্রেনের পানির মতো কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। বর্তমানে ঢাকা,নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের নদীর পানি এবং একটি ড্রেনের পয়ঃযুক্ত পানি দুটি পাত্রে রাখলে কেউ বলতে পারবে না কোনটি নদীর পানি।
ড্রেন এবং কারখানার বর্জ্য সরাসরি যাতে নদীতে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকার মতো পয়ঃবর্জ্য শোধন করে নদীতে ফেলতে হবে। তাই অনিতিবিলম্বে পাঁচ নদী সংস্কার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নদীর পানি দূষণ মুক্তির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে নদী বাঁচলে বাঁচবে জনগণ ও দেশ।বর্তমানে দূষণের মাত্রা এত বেড়েছে যে, যা আমাদের পরিবেশের জন্য তা হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। দিন দিন দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য এটি এক মহাসংকট হয়ে দেখা দিবে। তাই অধিক সংখ্যক নদী থাকার কারণে বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। এ দেশের সর্বত্র জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নদীগুলো। তাই এখনই এ ব্যাপারে আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। নদীগুলোকে রক্ষায় আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটি
Comments
comments